পিএইচ (pH)
পানিতে হাইড্রোজেন আয়নের পরিমান হলো পি এইচ, যা পুকুর বা জলাশয়ের পানি অম্লীয় না ক্ষারীয় তা নির্দেশ করে। পি এইচের স্কেল হলো ০--১৪। পি এইচ ০ হলে পানি অত্যাধিক অম্লীয় এবং ১৪ হলে পানি অত্যাধিক ক্ষারীয়। পি এইচ ৭ হলো পানির নিরপেক্ষ অবস্থা অর্থাৎ পানি অম্লীয় বা ক্ষারীয় কোনটিই নয় । পিএইচ ৭ এর কম হলে পানি অম্লীয় এবং ৭ এর বেশি হলে পানি ক্ষারীয় হয়ে থাকে । পার্শ্বের চিত্রের সাহায্যে দেখানো হয়েছে হাইড্রোজেন আয়ন বৃদ্ধি পেলে পানি অম্লীয়, পক্ষান্তরে হাইড্রোজেন আয়ন কমে গিয়ে হাইড্রোক্সিল আয়ন বৃদ্ধি পেলে পানি ক্ষারীয় হয় ।১) কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বনেট, বাইকার্বনেটঃ
প্রাকৃতিক পানির পিএইচ পানিতে অবস্থিত কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমান দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়ে থাকে কারন কার্বনডাই অক্সাইড হলো অম্লীয় যৌগ । এছাড়াও পিএইচ নিম্নলিখিত কারনে পরিবর্তিত হতে পারে----ক) পুকুরের অব্যবহৃত বা অতিরিক্ত খাদ্য ও জৈব পদার্থ অ্যান অ্যারোবিক (Anaerobic) ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা ভেঙ্গে জৈব এসিড তৈরি হলে পিএইচ কমে যায় ।
খ) বৃষ্টি বা জলাশয়ের আশেপাশের ধৌত হয়ে আসা খনিজ এসিড বা সালফিউরিক এসিড পানিতে পড়লে পিএইচ কমে যায় ।
গ) চুন প্রয়োগ করলে পিএইচ বেড়ে যায় ।
পানিতে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমান যতই বৃদ্ধি পেয়ে থাক না কেন পানির পিএইচ ৪.৫ এর নিচে নেমে যাবে না । পক্ষান্তরে পানিতে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমান যতই কমে যেয়ে থাক না কেন পানির পিএইচ ৮.৩ এর উপরে উঠবে না । অর্থাৎ পানিতে শুধুমাত্র কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমান হ্রাস বা বৃদ্ধির কারনে পানির পিএইচ কম বা বেশি হয়ে মাছ মারা যাবে না । তবে কার্বনেটের আধিক্যের কারনে পিএইচ ১১ এর উপরে উঠে যায় তখন মাছ মারা গিয়ে থাকে । সুতরাং কার্বনডাই অক্সাইড ও কার্বনেটের পরিমান নিয়ন্ত্রন করে পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রন করা যায় । উপরের চিত্রে বিষয়টি পরিস্কার করে দেখানো হয়েছে । পানির পিএইচ ৬.৫--৯ থাকলে পানিতে বাইকার্বনেটের আধিক্য থাকে যা মাছ চাষের জন্য ভালো ।
.২) দিনরাতের বিভিন্ন সময়ঃ
ফাইটোপ্লাংক্টন ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে পানি থেকে কার্বনডাই অক্সাইডউঠিয়ে নেয় ফলে দিনের বেলা পানির পিএইচ বৃদ্ধি পায় এবং রাতের সময় সকল প্রাণিকূল শ্বসনের মাধ্যমে পানিতে কার্বনডাই অক্সাইড নির্গত করে বিধায় কার্বনডাই অক্সাইডের আধিক্যের কারনে রাতে পানির পিএইচ কমে যায়। পানিতে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমান ভোরে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় বলে তখন পিএইচ কম থাকে এবং যখন সালোক সংশ্লেষণের হার সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় তখন কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমান সবচেয়ে বেশি কমে যায় বলে বিকালে পানির পিএইচ সবচেয়ে বেশি থাকে । সকল প্রাণীকূল অনবরত কার্বনডাই অক্সাইড উৎপাদন ও গ্রহণ করে থাকে, সুতরাং কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণের হার নির্ভর করে পুকুর বা জলাশয়ে ফাইটোপ্লাংক্টনের ঘনত্বের উপর । কার্বনডাই অক্সাইড অম্লীয় বিধায় তার উপস্থিতিতে পানির পিএইচ কমে যায় অর্থাৎ পিএইচ কম থাকলে পানিতে কার্বনডাই অক্সাইডের আধিক্য থাকে এবং বাইকার্বোনেট ও কার্বোনেটের পরিমান কমে যায়। উপরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণের কারনে বিকালে পানির পিএইচ সবচেয়ে বেশি থাকে এবং রাত্রে শ্বসনে কার্বনডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয় বিধায় পিএইচ ভোরে সবচেয়ে কম থাকে।
৩) ক্ষারকত্বঃ
পানির মোট ক্ষারকত্ব কম থাকলে ভোরে পানির পিএইচ ৬--৭.৫ থাকে এবং এরূপ পানিতে ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমান বা ঘনত্ব বেশি থাকলে বিকালে পিএইচ বৃদ্ধি পেয়ে ১০ বা তার বেশি হয়ে থাকে । পক্ষান্তরে ক্ষারকত্ব বেশি থাকলে পানির পিএইচ উঠানামার পরিমান বেশি হয় না । এরূপ ক্ষেত্রে ভোরে পানির পিএইচ সাধারনতঃ ৭.৫--৮ এবং বিকালে ৯--১০ হয়ে থাকে ।কোন কোন জলাশয় বা পুকুরে অধিক ক্ষারকত্ব এবং কম খরতা (Hardness) থাকে বিধায় সে সব জলাশয়ে ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমান বেশি থাকলে পানির পিএইচ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে বিকালে ১১ এর উপরে উঠে যায় । উপরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে ক্ষারকত্ব কম থাকলে পিএইচ দিনের বিভিন্ন সময়ে উঠানামার পরিমান বেশি কিন্তু ক্ষারকত্ব বেশি থাকলে পিএইচ উঠানামার পরিমান কম হয়ে থাকে ।
৪) তাপমাত্রাঃ
তাপমাত্রা হ্রাস বা বৃদ্ধির কারনে পানির পিএইচ কম বা বেশি হয়ে থাকে । পানিতে সালোক সংশ্লেষণের হার তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে এবং সালোক সংশ্লেষণের হারের উপর পানিতে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমান নির্ভর করে । এই কার্বনডাই অক্সাইডের কারনে পানির পিএইচ উঠানামা করে থাকে । পার্শ্বের চিত্রে দেখা যাচ্ছে তাপমাত্রা খুব বেশি থাকলে পানির পিএইচ কম থাকে কারন অত্যাধিক তাপমাত্রায় সালোক সংশ্লেষণের হার কমে যায় । আবার দেখা যাচ্ছে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা সর্বানুকূল তাপমাত্রায় পিএইচ ৬.৫ বা ৭.০ এর কাছাকাছি থাকে । তাপমাত্রা আরও কমে গেলে পানির পিএইচ বেড়ে যায়।৫) অ্যামোনিয়া ও অ্যামোনিয়ামঃ
অ্যামোনিয়া বা অ্যামোনিয়াম পানির পিএইচকে নিয়ন্ত্রণ করে না । তবে অ্যামোনিয়া , অ্যামোনিয়াম , তাপমাত্রা ও পিএইচের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। তাপমাত্রা ও পিএইচ বৃদ্ধি পেলে পানিতে মুক্ত অ্যামোনিয়ার( NH3) পরিমান বৃদ্ধি পায়। মুক্ত অ্যামোনিয়া মাছের জন্য ক্ষতিকারক । অপরদিকে তাপমাত্রা ও পিএইচ কমে গেলে পানিতে অ্যামোনিয়ামের পরিমান বৃদ্ধি পায় যা মাছের জন্য ক্ষতিকারক নয়। পার্শ্বের চিত্রের সাহায্যে বিষয়টি দেখানো হলো। পানির পিএইচ ৯ এর উপরে গেলে পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমান বেড়ে যায় । জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে পরিবেশের অর্থাৎ জলজ পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সমস্যা । পুকুরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা অসম্ভব । পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে সহজেই মাছ চাষের জন্য ক্ষতিকর মুক্ত অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদির বিষাক্ততা নিয়ন্ত্রণ সহজেই করা যায় ।
৬) ফাইটোপ্লাংক্টনঃ
পুকুর বা জলাশয়ে ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমান বা ঘনত্বের উপর পিএইচের উঠানামার পরিমান নির্ভর করে । পিএইচের প্রতিদিনের উঠানামার পরিমান ফাইটোপ্লাংটনের দ্বারা সংঘটিত সালোক সংশ্লেষণের হার নির্দেশ করে অর্থাৎ পিএইচ উঠানামার পার্থক্য বেশি হলে বুঝতে হবে পুকুরে ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমান বেশি বা ফাইটোপ্লাংক্টন ব্লুম হয়েছে । সুতরাং জলাশয়ের ভোরের অথবা বিকালের পিএইচ জানা থাকলে দূর থেকে চাষিকে মাছ চাষের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেয়া সম্ভব । এক কথায় জলাশয়ের পানির পিএইচ জলাশয়ের সার্বিক অবস্থার নির্দেশক হিসেবে কাজ করে । পিএইচ দিনে দুইবার পরিমাপ করা সম্ভব না হলেও শুধুমাত্র বিকালের পানির পিএইচ পরিমাপ করেই পুকুরের অবস্থা জানা যায় এবং সেই অনুযায়ী পরামর্শ দেয়া যায় ।সুখের বিষয় স্বাদু পানির বেশির ভাগ পুকুরে পিএইচ ৬--৯ এই রেঞ্জে থাকে এবং পিএইচ প্রতিদিন ১/২ এককের বেশি উঠানামা করে না । তবে পিএইচের প্রতিদিনের উঠানামার পার্থক্য ০.৫ একক হওয়া উচিৎ। পক্ষান্তরে আধালবণাক্ত পানির (Brakish water) পিএইচ সাধারণত ৮--৯ থাকে এবং প্রতিদিন পিএইচ উঠানামার পার্থক্য স্বাদু পানির চেয়ে কম হয়ে থাকে । বিকালের পিএইচ অল্প সময়ের জন্য ৯ বা ১০ থাকলে তা মাছ চাষের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না ।
Swingle ( 1967 ) বর্ণনা করেন অম্লীয় পানি মাছের ক্ষুধা এবং মাছের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয় । পিএইচ কম থাকলে মাছের উপর হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন, কপার এবং অন্যান্য ভারী ধাতুর বিষাক্ততা বৃদ্ধি পায়। পুকুরে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অম্লীয় পানি প্রভাব বিস্তার করে। এজন্য পানিতে সবুজ ফাইটোপ্লাংক্টন না থাকলে বা সার দেওয়ার পর পানি সবুজ না হলে ধরে নিয়ে থাকি পুকুরের পানি অম্লীয় । এছাড়া অম্লীয় পানিতে মাছ সহজেই পরজীবি ও অন্যান্য রোগ জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রবনতা থাকে।
সংক্ষেপে এক কথায় বলা যায় পানির পিএইচ ধ্রুব অবস্থায় থাকলে তা মাছ বা অন্যান্য জলজ জীবের জৈবিক কার্যকলাপের জন্য ভালো । মাছের রক্তের পিএইচ ৭.৪ । মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণি বিধায় জলজ পরিবেশের উপর মাছের জৈবিক ও শারীরবৃত্তিয় সকল কার্যক্রম নির্ভরশীল । এজন্য পানির পিএইচ মাছের রক্তের পিএইচের কাছাকাছি রাখতে না পারলে চাষের সময় মাছের উপর বিরুপ প্রভাব পরে ।
নিম্নে Swingle (1969) এর মতে মাছ ও জলজ জীবের উপর পিএইচের প্রভাব দেয়া হলো----
পিএইচ ( pH ) ফলাফল
১) ৪.0 অম্লীয় কারনে মাছ মারা যায় ।
২) ৪.০---৫.০ মাছের প্রজনন হয় না ।
৩) ৪.০---৬.৫ মাছ ধীরে বৃদ্ধি পায় ।
৪) ৬.৫---৯.০ মাছের ভাল ভাবে বৃদ্ধি হয় ।
৫) ৯.০---১১.০ মাছের ধীরে বৃদ্ধি হয় ।
৬) ৯.৫---১১.০ মাছের প্রজনন হয় না ।
১১) >১১.০ ক্ষারীয় কারনে মাছের মৃত্যু হয় ।
পিএইচ ( pH ) নিয়ন্ত্রণঃ
পিএইচ কমে গেলে বাড়ানোর জন্য যা করনীয়ঃ
১) পানিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে । প্রতিবার চুন প্রয়োগ করে তার ২/৩ দিন পর পিএইচ পরিমাপ করতে হবে । পিএইচ কাঙ্খিত মাত্রায় না পৌছা পর্যন্ত চুন আরও প্রয়োগ করতে হবে ।২) পানিতে সার প্রয়োগ করে বা অধিক খাদ্য প্রয়োগ করে পানিতে ফাটোপ্লাংক্টন তৈরি করলে পানির পিএইচ বেড়ে যাবে ।
পিএইচ বেড়ে গেলে কমানোর জন্য যা করনীয়ঃ
১) পুকুরে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে বা কয়েক দিন বন্ধ রেখে পানির পুষ্টির পরিমান কমিয়ে দিলে পিএইচ কমে যাবে ।২) পুকুরে পরিস্কার / স্বচ্ছ পানি প্রবেশ করিয়ে ধৌত ( Flushed ) করলে পিএইচ কমে যাবে ।
৩) পুকুরে ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমান বেশি থাকলে বা ব্লুম হলে পুকুরে মাছ থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ৫০০-৭৫০ গ্রাম করে চুন ( পাথুরে - CaO) সন্ধ্যার সময় ৩/৪ দিন পরপর ২/৩ বার প্রয়োগ করলে পুকুরের বিকালের পিএইচ আস্তে আস্তে কমে যাবে ।
৪) প্রতি শতাংশে ১-২ কেজি হারে জিপসাম (CaSo4,2 H2O) অথবা প্লাস্টার অফ প্যারিস ( CaSo4)2, H2O পানিতে প্রয়োগ করলে পিএইচ কমে যাবে । তবে কাঙ্খিত মাত্রায় পিএইচ নেমে না আসা পর্যন্ত একাধিক
বার প্রয়োগ করতে হবে। এই মাত্রায় জিপসাম প্রয়োগ মাছের জন্য নিরাপদ ।
৫) অ্যালাম বা ফিটকারি{ AL2(So4)3,14 H2O } প্রতিশতাংশে ৫০০-১০০০ গ্রাম গুড়া করে পানির সাথে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিলে পিএইচ কমে যাবে । পিএইচ কাঙ্খিত মাত্রায় নেমে না আসা পর্যন্ত একাধিক বার প্রয়োগ করতে হবে । এই মাত্রায় ফিটকারি প্রয়োগ মাছের জন্য নিরাপদ ।
মোঃ আব্দুস ছালাম প্রাং
খামার ব্যবস্থাপক
পার্বতীপুর( বদলীপ্রাপ্ত)
This comment has been removed by the author.
ReplyDelete